সূরা ফাতিহার ফজিলত

 

সূরা ফাতিহার ফজিলত

সূরা আল ফাতিহা কুরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূরা। প্রথমত, এই সূরা দ্বারাই পবিত্র কুরআন শুরু হয়েছে এবং এই সূরা দিয়েই আমাদের নামাজ শুরু করতে হয়।

অবতীর্ণ হওয়ার দিক দিয়েও পূর্ণাঙ্গরূপে এটিই প্রথম নাজিল হয়। সূরা ইকরা, সূরা মুজাম্মিল ও সূরা মুদাসসিরের কয়েকটি আয়াত অবশ্য সূরা আল ফাতিহার আগে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ সূরারূপে ফাতিহাই সর্বপ্রথম। অসংখ্য সাহাবি কর্তৃক বর্ণিত যে, এ সূরাই সর্বপ্রথম অবতীর্ণ সূরা, আর এ কারণেই এ সূরার নাম ফাতিহাতুল কিতাব বা কুরআনের উপক্রমণিকা রাখা হয়েছে।

সূরাতুল ফাতিহা মক্কায় অবতীর্ণ। এতে মোট সাতটি আয়াত আছে। এই সূরার ফায়দা ও উপকারিতা এবং বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য করে এর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। নিØে কিছু উল্লেখ করা হলো।

১। আল ফাতিহাঃ যেহেতু এ সূরা দিয়ে কুরআন শুরু হয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজ এই সূরা দিয়ে শুরু হয়। তাই সূরার নাম সূরাতুল ফাতিহা।

২। উম্মুল কিতাবঃ পূর্ণ কুরআনের আলোচ্য বিষয় তথা সারসংক্ষেপ এই সূরার মাঝে নিহিত বিধায় এই সূরার নাম উম্মুল কুরআন রাখা হয়েছে। ৩। আস শাফিয়াঃ যেহেতু এ সূরা দ্বারা সব রোগের চিকিৎসা করা হয়, তাই এর একটি নাম হলো সূরাতুস শাফিয়া। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাঃ বলেছেন, সূরা ফাতিহা সব রোগের ওষুধ।

এ ছাড়াও এই সূরার আরো কিছু নামঃ আল ওয়াফিয়া, আল কাফিয়া, আল আসাস, আল হামদ, আদদুআ। সূরা ফাতিহা এদিক দিয়ে সমগ্র কুরআনের সারসংক্ষেপ। এ সূরায় সমগ্র কুরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্তাকারে বলে দেয়া হয়েছে। কুরআনের অন্য সূরাগুলোতে প্রকারান্তরে সূরা ফাতিহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। কারণ সমগ্র কুরআন প্রধানত ঈমান এবং নেক আমলের আলোচনাতেই কেন্দ্রীভূত। আর এ দু’টি বিষয়েই সূরা ফাতিহায় আলোচনা করা হয়েছে।

আর এই সূরা কুরআনুল কারিমের শুরুতে আনার আরো একটি কারণ হলো, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতকারী তার অতীতের সব ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে মহান আল্লাহর সাথে কথা বলবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে যে, তিনি যেন তাকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দান করেন। সকল প্রকার গোমরাহি ও ভ্রান্ত মতবাদ থেকে মুক্ত করে তার প্রিয় বান্দাদের কাতারে শামিল করেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা দান করেন, যা একজন মানুষের জীবনের চরম ও পরম চাওয়া। উবাই ইবনে কাব রাঃ তিনি একবার রাসূল সাঃ-এর কাছে সূরা ফাতিহা পড়লেন, যা শুনে রাসূল সাঃ বললেন, ওই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, যে তাওরাত, ইঞ্জিল, জাবুর, এমনকি কুরআনেও এর মতো মর্যাদাশীল সূরা নেই (মুসনাদে আহমদ)।

হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে আসমান থেকে একজন ফেরেশতা রাসূল সাঃ-এর কাছে এসে বললেন, আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যে দু’টি আপনাকে দেয়া হয়েছে, যা আপনার আগে কোনো নবীকে দেয়া হয়নি, সে দু’টি হলো­ সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত।

যার প্রতিটি হরফের বিনিময়ে অফুরন্ত নেয়ামত ও নেকি দেয়া হয়। আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, সূরা ফাতিহা প্রত্যেক রোগের ওষুধবিশেষ।

মূলত সূরাতুল ফাতিহা হলো এমন এক মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সূরা, যা শুধু উম্মতে মুহাম্মদির জন্যই দান করা হয়েছে।

 

সূরা ফাতিহা একটি বিশ্লেষণ

সূরা আল-ফাতিহা অত্যন্ত বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্যপূর্ণ সূরা। এই সূরা দিয়ে পবিত্র কুরআনের সূচনা। এই সূরা অন্যান্য সূরা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ও স্বীয় বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান। প্রত্যেক নামাজের প্রতিটি রাকাত এই সূরা দিয়ে শুরু হয়। পূর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ সূরা হিসেবে এটা পাক কুরআনে প্রথম অবতীর্ণ সূরা। এ কারণে বহু মুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদ এ সূরাটিকে পাক কুরআনের ভূমিকা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

সূরা আলফাতিহা পুরো কুরআনের নির্যাস। কুরআনের সব বিষয়বস্তু ও মূল ভাব এই সূরায় বিধৃত হয়েছে। আল্লাহর একত্ব ও বড়ত্বে অকৃত্রিম বিশ্বাস এই তত্ত্ব-দর্শন পবিত্র কুরআনে সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সংক্ষিপ্তাকারে সূরা ফাতিহা যেন এরই প্রতিধ্বনি। এ সূরা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন­ ‘উম্মুল কিতাব’ কুরআনের মা, ‘উম্মুল কুরআন’ কুরআনের জননী, ‘কুরআনুল আজিম’ মহাগ্রন্থ আল কুরআন।

সূরা আল-ফাতিহার বাংলা অনুবাদ নিুরূপঃ পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম। ১. যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সব সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। ২. তিনি অসীম মেহেরবান ও দয়ালু। ৩. তিনি বিচার দিনের মালিক। ৪. আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। ৫. আমাদের সরল পথ দেখাও। ৬. সেসব লোকের পথ, যাদের তুমি নেয়ামত দান করেছ। ৭. তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাজিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

সূরা আল-ফাতিহা বা সা’ব আল মাসানি (পুনঃপুন পঠিত সপ্ত আয়াতবিশিষ্ট)। প্রচলিত ভাষায় এ সূরা আলহামদুলিল্লাহ সূরা নামে সমধিক পরিচিত। ভাব ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এই সূরার সাতটি আয়াতকে তিন অংশে বিভক্ত করা যায়ঃ ক. আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলি সম্পর্কিত আয়াত (আয়াতঃ ১-৩), খ. মানুষ তথা সৃষ্টিজগতের সাথে আল্লাহর সম্পর্কবিষয়ক আয়াত (আয়াতঃ ৪) এবং গ. আল্লাহর কাছে প্রার্থনা আবেদন-নিবেদন সংবলিত আয়াত (আয়াতঃ ৫-৭)। এবার বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনা করা যেতে পারে।

আয়াতঃ ১-৩ সূচিত হয়েছে আল্লাহ্‌র প্রশংসা ও গুণাবলি দিয়ে। আয়াত-১-এ উল্লিখিত হয়েছেঃ ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্‌র, যিনি সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। এই আয়াতের দু’টি অংশঃ ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর’ এবং ‘তিনি সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা’। কেন আল্লাহ্‌র জন্য সব প্রশংসা­ এর উত্তর আয়াতের দ্বিতীয় অংশে প্রদত্ত হয়েছে। আল্লাহ্‌র জন্য সমুদয় প্রশংসা, কারণ তিনি সব সৃষ্টি জগতের প্রভু, মালিক। অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির পশ্চাতে রয়েছে আল্লাহ্‌র একক সার্বভৌমত্ব। এই সার্বভৌমত্বের কারণেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও আনুকূল্য লাভের প্রত্যাশায় মানুষ তাঁর প্রশংসা ও স্তুতির মুখাপেক্ষী। যাঁর কারণে এবং যাঁর জন্য এ সৃষ্টি, তাঁর প্রতি বিনীত হওয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সৃষ্টিজগৎ বলতে কী বোঝায়? ক্ষুদ্র আরবি শব্দ ‘আলম’, যার অর্থ ‘জগৎ’। ‘আলম’-এর বহুবচন ‘আলামিন’ বলতে বোঝায় ‘জগৎসমূহকে’ অর্থাৎ যাবতীয় সৃষ্টি জগৎকে। আসমান-জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে সৃষ্টি সব ধরনের বস্তু। যেমন­ আকাশ-সূর্য-গ্রহ-তারা-নক্ষত্ররাজি-বিজলি, ফেরেশতাকুল, জিন ও মানব, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল­ সব জড় পদার্থসহ আধ্যাত্মিক জগতের দ্রব্য-সত্তা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। সৃষ্ট জীবের মধ্যে যা কিছু দৃশ্যমান এবং যা কিছু অদৃশ্যমান, সব কিছুই সমজাতীয় ভিত্তিতে একেকটা মণ্ডল বা জগৎঃ যেমন- প্রাণিজগৎ, উদ্ভিদজগৎ, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল ইত্যাদি। যাবতীয় জগতের সৃষ্টির মূলে রয়েছে আল্লাহ্‌র একচ্ছত্র মালিকানা বা প্রভুত্ব। তিনি এক, একক, অদ্বিতীয় ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো তথাকথিত প্রভু, দেবদেবী বা উপাস্য নেই। একমাত্র উপাস্য হিসেবে তিনিই পূজনীয়। আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই, ইসলামের এই মূল বাণী এই আয়াতে অন্তর্লীন হয়ে আছে।

মহান আল্লাহ্‌র প্রশংসা ও তারিফের পর এবার অর্থাৎ পরের আয়াত ২-৩-এ তাঁর গুণাবলির কথা ব্যক্ত করা হয়েছেঃ তিনি ‘রহমান ও রাহিম’ অর্থাৎ পরম করুণাময় ও দয়ালু। আরবি শব্দ ‘রহমান’ এবং ‘রাহিম’ উভয়ই আল্লাহ্‌র আধিক্যবাচক বিশেষণ। সমগ্র সৃষ্ট জগতের ওপর আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, করুণা ও অবদান সাধারণত দুই ধরনের। ক. আয়াস-নিরপেক্ষ অবদান খ. আয়াসলভ্য অবদান। আয়াস-নিরপেক্ষ অবদান হচ্ছে সেই­ যা বিনা কষ্টে, বিনা পরিশ্রমে, জতি-ধর্ম-নির্বিশেষে, পাপ-পূর্ণ-ভেদাভেদে সবাই প্রাপ্ত হয়; যেমন­ পানি, বায়ু, সূর্যকিরণ প্রভৃতি। অন্য দিকে আয়াস-লভ্য অবদান হচ্ছে সেই­ যা শ্রম-কষ্টের বিনিময়ে অর্জন করা হয়। যেমন­ জমির ফসল, প্রাণীর আহার সংস্থান, আত্মবিকাশ ইত্যাদি। সৃষ্ট জীবের জন্য আয়াস-নিরপেক্ষ অবদানগুলো আল্লাহ্‌র ‘রহমান’ বা করুণা গুণের এবং আয়াস-লভ্য অবদানগুলো তার ‘রাহিম’ বা দয়ালু গুণের পরিচায়ক। বাইবেলে ‘রহমান’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে অর্থাৎ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয়ের ওপর আল্লাহ্‌র করুণা বা অনুগ্রহকে অর্থ করে। পক্ষান্তরে ‘রাহিম’ শব্দটি সঙ্কীর্ণ অর্থে অর্থাৎ কেবল বিশ্বাসীদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে নির্দেশ করে।

তৃতীয় আয়াতে আল্লাহর আরো একটি গুণের কথা উল্লিখিত হয়েছেঃ তিনি বিচারদিনের মালিক।’ আরবি আয়াত ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দিন’- ‘মালিক’ শব্দের অর্থ­ কোনো বস্তুর ওপর এমন অধিকার থাকা, যাকে ব্যবহার, রদবদল, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার অধিকার ও ক্ষমতা থাকে। ‘দিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ প্রতিদান দেয়া। মালিকি ইয়াওমিদ্দিন-এর অর্থ দাঁড়ায়ঃ প্রতিদান দিবসের মালিক বা অধিপতি। অর্থাৎ প্রতিদান দিবসে সব সৃষ্টি এবং বিষয়ের ওপর মহান আল্লাহ্‌র একচ্ছত্র অধিকার ও আধিপত্যের প্রভাব ও ক্ষমতা থাকবে। সূত্রঃ তাফসিরে মা’আরেফুল কুরআন, পৃ-৪।

ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বিহাক বর্ণনা করেনঃ প্রতিদান দিবসের ‘মালিক’-এর তাৎপর্য হচ্ছে­ দুনিয়াতে যদিও অন্যান্য বিচারপতি আছেন, পরকালে কারোর হাতে কোনো বিচারিক ক্ষমতা থাকবে না। সেই দিন আল্লাহ্‌র বিচারকাজে কেউ শরিক হতে পারবে না। সূত্রঃ তফসিরে ইবনে কাছির, ১ম. পৃ-১৬৯।

আগেই বলা হয়েছে, সৃষ্ট জগতের যাবতীয় ক্ষমতার উৎস ও মালিকানা আল্লাহর। যেমন­ তিনি বলেন, ‘আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী হব এই পৃথিবীর এবং তার ওপর যারা আছে তাদের এবং আমারই কাছে তারা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ তবে বিশেষ করে বিচারদিনের মালিক ‘আল্লাহ্‌’­ এ কথা বলার অর্থ ও তাৎপর্য কী? বিচার দিবস বলতে বোঝায় সেই দিবসকে, যে দিন মানুষ ‘তথা সৃষ্ট জীবের কৃতকর্মের চূড়ান্ত ফয়সালা বা মীমাংসা হবে­ যে দিন এ জগতে পালিত কৃতকর্মের চুলচেরা হিসাব গ্রহণ করা হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া হবে। এ বিচারকাজের দায়ভার সম্পূর্ণ আল্লাহ্‌র হাতে ন্যস্ত থাকবে। আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারের ধারক ও বাহক। তাঁর বিচারকাজ নিখুঁত ও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমি তাদেরকে সমবেত করব­ যে দিনের আগমনের কোনো সন্দেহ নেই। আর নিজেদের কৃতকর্ম তাদের প্রত্যেকেই পাবে­ তাদের প্রাপ্য প্রদানে মোটেই অন্যায় করা হবে না (৩ঃ২৫)। সে দিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভালো কাজ করেছে চোখের সামনে তা দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তা-ও দেখতে পাবে (৩ঃ৩০)। যে দিন তারা বের হয়ে পড়বে, আল্লাহর কাছে তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। আজ রাজত্ব কার? এক প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহর। আজ প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের প্রতিদান দেয়া হবে। আজ জুলুম নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। চোখের চুরি, অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন। আল্লাহ ফয়সালা করেন সঠিকভাবে (৪০ঃ১৫-১৬, ১৯)। যিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল এবং মধ্যবর্তী সব কিছুর পালনকর্তা, যেদিন ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেন সে ব্যতীত তার সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সত্য বলবে। এ দিবস সত্য, সে দিন মানুষ প্রত্যক্ষ করবে যা সে সামনে প্রেরণ করেছে’ (৭৮ঃ৩৭-৪০)। সে দিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কর্মফল দেখানো হয়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে, কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে (৯৯ঃ ৬-৮)। পবিত্র কুরআনে এসব উদ্ধৃতিকে বিচার দিবসে মানুষের কৃতকর্মের অনুসারে ন্যায্যবিচার পাওয়ার আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পুনঃপুন ব্যক্ত করা হয়েছে।

পরবর্তী আয়াত (আয়াত নম্বর ৪) ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ এ আয়াতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে­ এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সৃষ্টি জগতের তথা মানুষের সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, এ আয়াতটি আমার এবং আমার বান্দাদের মধ্যে সংযুক্ত। কারণ এর এক অংশে আমার প্রশংসা এবং অপর অংশে বান্দাদের দোয়া ও আয়াত রয়েছে। আয়াত ১-৩ পর্যন্ত আল্লাহর প্রশংসা, গুণাবলি এবং বিচার দিবসের মালিকানা বিষয় বর্ণিত হয়েছে; অর্থাৎ আলোচনা আল্লাহর প্রসঙ্গ নিয়েই আবর্তিত। ৪ নম্বর আয়াতে এসেই আল্লাহর সাথে মানুষের আকুল আবেদনঃ ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, অর্থাৎ উপাস্য হিসেবে অন্য সব কিছুকে (যথা­ দেবদেবী, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা প্রভৃতি) বর্জন করে একমাত্র আল্লাহর দিকেই মুখ রজ্জু করা হয়েছে। ‘লা শারিক আল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই­ এই ভাবধারা এখানেও এ আয়াতে পরিস্ফুটিত। শুধু তা-ই নয়, আপদে-বিপদে দুঃখ-কষ্টে, জরা-ব্যাধি ইত্যাদি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহর সার্বভৌম সত্তা এবং তাঁর এককতার কাছে আত্মসমর্পণ করা হয়েছে। ৫-৭ নম্বর আয়াতে অদ্বিতীয় পরম আল্লাহর কাছে এক আকুল প্রার্থনা এবং আবেগঘন আবেদন উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই আবেদনের নিয়মকানুন ও রীতিপদ্ধতি স্বয়ং আল্লাহই শিখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় অংশ (অর্থাৎ আয়াত নম্বর ৫-৭) আমার বান্দাদের জন্য।’ সে যা চাইবে তাই পাবে। প্রার্থনার আবেদনটি অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং আগে উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক। মহান আল্লাহর দরবারে মানবজাতির আকুল প্রার্থনাঃ হে আল্লাহ, আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। সরল পথের বর্ণনায় প্রথমে সমর্থক এবং পরে নঞর্থক উপায়ে নিশ্চিত করা হয়েছেঃ যেমন­ তাদের পথ, যার অনুসরণে মানুষ হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়, আল্লাহর আনুকূল্য ও অনুগ্রহ লাভ করে এবং আশীর্বাদপুষ্ট হয়। তাদের পথে নয়, যা অনুসরণ করে মানুষ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয় এবং আল্লাহর গজবে পরিণত হয়। এবারে সবচেয়ে বড় ও কঠিন প্রশ্ন হচ্ছেঃ সরল পথ বলতে কী বোঝায়? এ বিষয়ে তাফসিরকারকদের মতের ভিন্নতা রয়েছে, তবে এর কোনোটিই মূল অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কেউ বলেন, সরল পথ হচ্ছে পূর্ণরূপে বক্রতামুক্ত সুস্পষ্ট পথ। সব আরব গোত্র এই অর্থেই শব্দটা ব্যবহার করেছে।

কারো কারো মতে, সরল পথ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পথ। কেউ আবার সরল পথ বলতে পবিত্র কুরআনকে অর্থ করেন। কেউ বলেনঃ এ হচ্ছে ইসলাম সত্য বা আল-হাক্ক। এ সত্য পথ প্রদর্শনকে অর্থ করে। ওপরে উল্লিখিত প্রত্যেকটি মতকে সঠিক ও নির্ভুল বলে ভাবা যেতে পারে। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও সাহাবিদের অনুসরণ করে, সে আসলে ইসলামকে অনুসরণ করে। যে ইসলাম অনুসরণ করে সে প্রকৃতই ‘আল-কিতাব’ বা পবিত্র কুরআনকে অনুসরণ করে। আর কুরআন হলো আল্লাহর ‘কিতাব’ তাঁর প্রদর্শিত সাহজ সরল পথ। প্রশ্ন হচ্ছে­ কারা সরল পথে আছেন? তারাই সরল পথে রয়েছেন, যাদের ওপর আল্লাহর ‘নেয়ামত’ বর্ষিত হয়েছে। সূরা নিসা (৪ঃ৬৯) আয়াতে আল্লাহ তাদের পরিচয়সূত্রে বলেনঃ অনন্তর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করে, তারাই সেই সব বান্দার সাথে থাকবেন, যাদেরকে আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহে বিভূষিত করেছেন। তারা হচ্ছেন নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহিদগণ এবং কতই না উত্তম সঙ্গী তারা। আল্লাহর তরফ থেকে এই দান। নেতিবাচক ভঙ্গিমায় আল্লাহর অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের কথা বলা হয়েছে। কারা অভিশপ্ত? যারা সত্যকে জেনেশুনে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই অভিশপ্ত। কারা পথভ্রষ্ট? যারা অজ্ঞতার কারণে সত্য পথ থেকে বিচুøত হয়েছে, তারাই পথভ্রষ্ট। কেউ কেউ ‘অভিশপ্ত’ বলতে ইহুদি জাতিকে অর্থ করেন এবং ‘পথভ্রষ্ট’ বলতে খ্রিষ্টান বা নাসারাদের নির্দেশ করেন।

 

Source: http://mamunmck.wordpress.com

Leave a comment